নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন”-র সংশোধনী প্রস্তাবে ই-সিগারেটের প্রচার, প্রসার, আমদানি, রপ্তানি, পরিবেশন, বিপণন নিষিদ্ধের প্রস্তাব দেওয়ার পর কয়েকটি বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিভিন্ন উপায়ে দেশে অত্যন্ত ক্ষতিকর এ পণ্যের প্রচারে নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে ই-সিগারেট উৎপাদন ও প্রসারে সিগারেট কোম্পানির উদ্যোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম সংকটের কারণ হতে পারে। আজ শনিবার (২৫ নভেম্বর ২০২৩) বিকেল ৩ টায় ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত ২২টি সংগঠন যৌথভাবে ‘ই-সিগারেট/ভেপিং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি : নিষিদ্ধ জরুরি’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বিদেশী সিগারেট কোম্পানি বিএটি সম্প্রতি বাংলাদেশে ভোক্তাদের আধুনিক জীবনধারার কথা উল্লেখ করে নতুন কিছু আর্ন্তজাতিক মানের পণ্যের আমদানি করার অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে তারা এধরণের পণ্যের চাহিদা নিরুপণে দেশের বাজারে এসকল পণ্য বিক্রয় করবে এবং পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে এ পণ্যের উৎপাদন, পরিবেশন, বিপণন ও রপ্তানি করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। তাদের এ ধরনের প্রচেষ্টা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। গণমানুষের কথা চিন্তা করে অতিদ্রুত ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি বিশিষ্ট ক্যান্সার বিষেশজ্ঞ ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক সিগারেট কোম্পানির মিথ্যাচার নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কম ক্ষতিকর টার্ম ব্যবহার করে তামাক কোম্পানিগুলো তরুণ-যুবক এবং ধূমপায়ীদের ই-সিগারেটে আকৃষ্ট করছে। ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর নয়, বরং খুবই ক্ষতিকর একটি পণ্য। ই-সিগারেটের ব্যবহার ও বাজার সম্প্রসারণের জন্য কোম্পানিগুলো ভ্যাপিং উৎসবের আয়োজন করছে, যা যুব সমাজ নতুন ভাবে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী এর স্বপক্ষে বিভিন্ন মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এপিডেমোলজি বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ায় ই-সিগারেট বন্ধের সুপারিশ করেছে। দেশের প্রায় ১৫০ জনের বেশি সংসদ সদস্য ই-সিগারেট বন্ধের সুপারিশ করেছে এবং সরকার তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত ই-সিগারেটের প্রচার ও প্রসার খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। এমতাবস্থায় এখনই ই-সিগারেটের লাগাম টেনে না ধরলে পরবর্তীতে আইন করেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তামাক কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর এবং এটি ধূমপান ছাড়তে সহায়ক হিসেবে তাদের মিথ্যা প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আহসানিয়া মিশনের পরিচালক (হেলথ এন্ড ওয়াস) ইকবাল মাসুদ বলেন, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ আইন- ২০০৫ অনুসারে তামাক কোম্পানির সিএসআর এবং তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু সিগারেট কোম্পানি গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করে শুধু আইনভঙ্গই করছে না, ই-সিগারেট প্রমোশনের চেষ্টা করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বিদেশী সিগারেট কোম্পানি বিএটি ই-সিগারেট প্রসারের লক্ষ্যে গোপনে কাজ করছে এবং ঢাকায় তাদের সহযোগীতায় পরিচালিত প্রায় ৩০ টিরও বেশি ই-সিগারেট দোকান পাওয়া গিয়েছে।
প্রত্যাশা মাদকবিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ, দেশের মানুষকে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত করে সরকারের উপর চিকিৎসার দায় বাড়িয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ছে। প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার দেশের বাইরে নানাভাবে পাচার করছে এ সিগারেট কোম্পানি। এ লাভে তারা তুষ্ট নয়, এদেশের মানুষকে আরো বেশি সিগারেটে আক্রান্ত করে, আরো মুনাফার পাহাড় গড়তে ই-সিগারেট/ভেপিং বাজার সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে।
সভাপতিত্ব করেন মানস এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. অরুপ রতন চৌধূরী বলেন, সরকারের তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসডিজি অর্জনের অঙ্গীকার, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সংবিধানিক দায়বদ্ধতা, আদালতের নির্দেশনার পরও সিগারেট কোম্পানিগুলো এ দেশে আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে ই-সিগারেট বন্ধে ৯টি সুপারিশ করা হয় ১.বাংলাদেশে ই-সিগারেটের আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন, পরিবেশন, বিজ্ঞাপন বা প্রচার-প্রচারণা বন্ধে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; ২. নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজে ই-সিগারেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; ৩. অনলাইন বিজনেস সাইটসহ ই-সিগারেটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা; ৪. বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক আমদানি নীতিতে ই-সিগারেট জাতীয় পণ্য আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা; ৫. অর্থ বিভাগ ও রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক ই-সিগারেট, এর ডিভাইস, ই-লিকুইড, রিফিলসহ এ জাতীয় সকল পণ্যের এইচআর কোড পণ্যের তালিকা প্রত্যাহার করা; ৬. সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা অন্য কোন নতুন নেশা জাতীয় বা তামাক জাতীয় অথবা নিকোটিন আছে এমন কোন পণ্যের অনুমোদন না দেয়া; ৭. ই-সিগারেট প্রসারে কার্যরত সিগারেট কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের গোপন তৎপরতা অনুসন্ধান করে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া; ৮. ই-সিগারেট বা ভেপিং জাতীয় পণ্যের ট্রেডমার্ক বা যে কোন ধরনের নিবন্ধন বাতিল করা; ৯. অতিদ্রুত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত খসড়া পাশ করে বাংলাদেশকে ই-সিগারেট মুক্ত করা।
টিসিআরসির প্রোগ্রাম অফিসার ফারহানা জামান লিজার উপস্থাপনায় সাংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, এইড ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী, ডাসের উপদেষ্টা আমিনুল ইসলাম বকুল প্রমুখ।